– মাহমুদুল করিম, এসএসসি’১১

মহান রাব্বুল আলামীনের নামে শুরু করছি, যিনি সমগ্র দুনিয়া ও পরকালের একমাত্র মালিক মহান আল্লাহ তা’লা। প্রায় বছরখানেক পর হাতে কলম নিলাম। স্বাধীনতার মোড়কে পরাধীন দেশে কোথায় বা লিখবো, আর সেটা পড়বেই বা কে? তবে এবার প্রাণের বিদ্যালয়ের ৭১ বছর পূর্তির লোভটা সামলাতে না পেরে লিখতে বসা। সর্বশেষ এক বছর আগে হাইস্কুল নিয়ে লিখেছিলাম। বেশ কিছু মানুষের সাধুবাদ পেয়েছিলাম। এবারও ওদের আগ্রহেই কালি-কলমের এই অর্থহীন ব্যবহার। লেখার শুরুতেই তারিখটা বলে রাখি। আজ ৯ ই মার্চ ২০১৮। কক্সবাজার সদর উপজেলার প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ ঈদগাহ্ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। এটি খুবই ঐতিহাসিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়টি খান বাহাদুর মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর দাদা খান বাহাদুর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী তার নিজের জমির উপর প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন ১৯৪৬ সালে। একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যখন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, শিক্ষা যখন সোনার হরিণ রুপে আবির্ভূত ঠিক তখন’ই উক্ত স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সকল কোমলমতি শিশু ও শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়ে অমর হয়ে আছেন খান বাহাদুর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী সাহেব। অত্র বিদ্যালয়ে বর্তমানে শ্রেণিভিত্তিক ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১২০০ জন। বৃহত্তর ঈদগাঁওতে শিক্ষার আলো ছড়াতে এই বিদ্যালয়টি শুরু থেকে অদ্যাবধি খুবই ভুমিকা রেখেছে এবং রেখে চলেছে। অবস্থান-আয়তন, অবকাঠামো-শিক্ষার মান ও গুরুত্বের দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় বৃহত্তর ঈদগাঁওর একমাত্র এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের নাম ঈদগাহ্ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। সম্প্রতি জনাবা খুরশিদুল জান্নাত ম্যাম ভারপ্রাপ্ত থেকে প্রধান শিক্ষিকা হওয়ার পর উক্ত স্কুলের পড়ালেখার মান ও সার্বিক উন্নয়ন যেন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাতে অবশ্য সকল শিক্ষক-কর্মচারীর অবদান ও আন্তরিকতা অনস্বীকার্য। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একুশে পদক পাওয়া জাতিসত্তার কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা, ডিজিএফ আইয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান কাজল, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মাফরুহা মেরি, ঢাকা বিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল হক (শাহ জাহান), ড. সলিম উল্লাহ, ব্যারিষ্টার মিজান সাঈদ, ব্যারিষ্টার নুরুল আজিম, কর্নেল এহসান, কর্নেল ফোরকান আহমদ (বর্তমান কউক চেয়ারম্যান), ব্যারিস্টার নুরুল আজিম, নিবার্চন সচিব হেলাল উদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সিরাজুল হক শাহাজাহানসহ অসংখ্য গুণীজন। তার মাঝে অবশ্য আমিও এক নগণ্য মানব এই গুণীজন সৃষ্টির কারখানায় পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিদ্যালয়ে সকল প্রিয় স্যারদের মাঝেও প্রিয় ছিল মরহুম ফরিদ স্যার, মরহুম গোপাল স্যার, মরহুম সলিম স্যার, মরহুম রশিদ স্যারসহ মোজাম্মেল স্যার এবং আমানুল্লাহ ফরাজি স্যার। যারা নিজের জীবন থেকে অর্ধেকের বেশি মূল্যবান সময় দিয়ে সুখ ত্যাগ করে ছাত্র-ছাত্রীদের মানুষের মত করে মানুষ বানানোর জন্য অনবরত পরিশ্রম করে গিয়েছিলেন। স্যারদের মধ্যে যারা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন ওনারা যদি বেঁচে থাকত তবে আজ নিশ্চয় তৃপ্তির হাঁসি হেসে অঝোর জল ত্যাগ করত নয়নমণি দিয়ে! ওনারা দেখত আজ স্কুলটা সত্যি অনেক বড় হয়ে গেছে। হাটিহাটি পা পা করে আজ ৭১ টি বছর অতিক্রম করছে। আমি স্কুলের দেয়ালের দিকে তাকালে এখনও দেখতে পাই ফরিদ স্যারকে! যিনি আমাকে পানের জন্য পাঠাচ্ছেন, উপদেশ দিচ্ছেন প্রতিদিন স্কুলে আসার জন্য। আমি দেখতে পাই রশিদ স্যার পড়াচ্ছেন চাকরির চেয়ে কেন ব্যবসা উত্তম। শুনতে পাই গোপাল স্যারের সেই যুক্তিনির্ভর মধুর উক্তি গুলো। মাঠের দিকে তাকালে দেখতে পাই সলিম স্যারকে। যাকে আমি বল করতে গিয়ে টানা ৩টি ওয়াইড দিয়েছিলাম। আমি আজ অনেকটা অনুতপ্ত। এমন কিছু গুণিজনের সান্নিধ্য পেয়েও আমার মূর্খতার কারণে জ্ঞানের পুর্নতা পাইনি। আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি প্রিয় স্যারদের। আমি সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করি যাদের জ্ঞানের ভান্ডার থেকে অল্প সংগ্রহ করেও অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে পড়িয়েছি। আমি বিদ্যাসাগরকে পড়ার পর বইয়ের পাতা ছিড়ে ফেলতে দেখিনি, আমি দেখেছি শের আলী স্যারকে বইয়ের পাতার লিখা নির্ভুল ভাবে লাইন বাই লাইন মুখস্থ বলতে। আমি এখনও দেখতে পাই মোজাম্মেল স্যারকে, যিনি ক্লাসে টেবিলের উপর ১০০ টাকার টাটকা নোট রেখে সঠিক উত্তরদাতার জন্য পুরস্কার বলে উৎসাহ দিত। আমি আজ লজ্জিত, কারণ বুঝেছি খুরশিদুল জান্নাত ম্যাম কেন আমাকে নিচের নলকূপের (পাশে মেয়েদের ক্লাসরুম ছিল) পাশ থেকে ডেকে নিয়ে আদরের সহীত শাসন করেছিল। আমি সেই সাথে সকল শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি কৃতজ্ঞ ও ঋণী। যারা আমার মত অমানুষকে মানুষ বানানোর দায়িত্ব কাধে তুলে নিয়েছিল। ঘনিয়ে আসছে বহুদিনের প্রতিক্ষার ৭১। পুনর্মিলন (১৯৪৬-২০১৮) ১০ ই মার্চ। দেখা হবে পুরানো বন্ধুগুলোর সাথে। ফিরে যাবে সেই ১০-১৬ বয়সের যৌবনে, কৈশোরের স্মৃতি গুলো উল্টে দেখা হবে। অবশ্য আমিও যেতাম, আমিও মজা করতাম, আমিও স্মৃতির পাতা খুলে নিজেকে ১৪ বছর বয়সের ছাত্র হিসাবে আবিস্কার করতাম যদি আমি রেমিটেন্স যুদ্ধা না হতাম। তাই আক্ষেপটা যেন রয়ে গেল। সবার জন্য দোয়া শুভ কামনা এবং পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের সফলতা কামনা করছি।

লেখক – এসএসসি’১১ ব্যাচ ও প্রবাসী